নভেল করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) কারণে ঘোষিত লকডাউন বা সাধারণ ছুটিতে দেশের ৮৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাদ্য ও পুষ্টি সংকটে পড়েছে। অন্যদিকে ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৪২ শতাংশ মানুষ কোনো ধরনের মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম খেতে পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি বা বেসরকারিভাবে প্রদান করা কোনো ধরনের সহায়তা পায়নি প্রায় ৫২ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। আবার যারা পেয়েছে তাদের অর্ধেকই বেসরকারি সুবিধা।
‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ পরিচালিত দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন।
খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে এবং খাদ্য অধিকার বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলীর সঞ্চালনায় এ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এসএম জুলফিকার আলী।
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনকালে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দরিদ্র পরিবারগুলোর ৫ শতাংশই দিনে মাত্র একবেলা খেয়েছে। মহামারী শুরুর আগে উত্তরদাতাদের ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ দিনে তিন বেলা এবং বাকিরা দুবেলা খাবার গ্রহণ করত। যদিও বেশির ভাগ উত্তরদাতা সাধারণ সময়ে তিন বেলা খাবার গ্রহণ করত, কিন্তু সাধারণ ছুটির সময়ে বিভিন্ন বিভাগের ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ উত্তরদাতা তিন বেলা খাবার গ্রহণে সমস্যার মুখোমুখি হয় বলে জানিয়েছে। অর্ধেক দরিদ্র মানুষ সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে কিছু খাদ্য ও অর্থসহায়তা পেয়েছিল।
জানা গেছে, জরিপটি গত মাসের মধ্য ভাগ থেকে জুন পর্যন্ত উত্তরদাতাদের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে এবং ফোন কলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। ৩৭টি জেলার ৮৩৪ জন দরিদ্র লোকের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ চালানো হয়েছিল। এতে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে চারটি জেলা, রংপুর থেকে সাতটি, রাজশাহী থেকে ছয়টি এবং ঢাকা থেকে পাঁচটি জেলার তথ্য রয়েছে।
আলোচনায় ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গরিব ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আবার তাদের ধারকর্জ করার সুযোগও কমে গেছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সহায়তা অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম দিয়ে আমরা সব দরিদ্র মানুষ তথা তাদের চাহিদাকে পূরণ করতে পারছি না। এজন্য দরিদ্র মানুষের একটি চলমান হালনাগাদ ডাটাবেজ থাকা দরকার। তাহলে খুব সহজেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সহায়তাগুলো পৌঁছানো যাবে।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, সরকারের উচিত দরিদ্রদের সহায়তা বাড়ানো, আর এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত ও এনজিওদেরও যুক্ত করা প্রয়োজন। এ মহামারীকালে আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছি, খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন থাকা কতটা জরুরি।
ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এরই মধ্যে পাঁচ কোটি পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ জরিপের ফলাফলকে মানতেই হবে যে, সব মানুষের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা করোনাকালে সংকটের মধ্যে পড়েছে। ৫০ লাখ পরিবারের জন্য যে অর্থসহায়তা প্রদানের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছিল তা কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। খাদ্যসহায়তার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ১৫ লাখের মধ্যে ছয় লাখের তালিকায় সমস্যা রয়েছে, যা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হলে বছরব্যাপী দরিদ্র মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ ফুড প্যাকেজ অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলে পুষ্টিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তার জন্য আরো ব্যাপকভিত্তিক গবেষণার দরকার রয়েছে।
Leave a Reply