প্রতি বছর ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর গাবতলীর পশুরহাট জমজমাট হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু-ছাগল নিয়ে আসতে থাকেন ব্যাপারীরা। ঈদের ১০-১২ দিন আগে বেচাকেনা জমে ওঠে। অনেক ব্যাপারী গাবতলী হাট থেকে পশু কিনে আবার এখানেই বিক্রি করেন। দূর দূরান্ত থেকে আসা ব্যাপারীরা ভালো দাম পেলে ঈদের আগেই পশু বিক্রি করে চলে যান। আর দুই সপ্তাহ পরেই কোরবানির ঈদ। কিন্তু এবার গাবতলী পশুরহাটের অধিকাংশ জায়গা এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। পাবনা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা থেকে অনেকে গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন, কিন্তু ক্রেতা নেই। বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ব্যাপারী গাবতলী হাটে এসেছেন তারা বলছেন, এবার হাট জমবে না। গত ১৬ জুলাই সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে ৭টি গরু নিয়ে গাবতলীর হাটে এসেছেন আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ১০টায় হাটে এসে পৌঁছেছি। বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো গ্রাহক নেই। এর আগে যারা গ্রাম থেকে এসেছিল তারা ৫-৬ দিন থেকে লস দিয়ে গরু বিক্রি করে চলে গেছে। তারা বলেছে, গরু ফিরিয়ে নিয়ে গেলে বা আরও বেশিদিন থাকলে আরও বেশি ক্ষতি হয়। সে কারণে কম দামে গরু বিক্রি করে চলে গেছে। এ ব্যাপারী বলেন, এবার গরুর হাট জমবে না। এটা এখন থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ প্রতিবার এই সময় গাবতলী গরুর হাট ভরে যায়। এবার এখন পর্যন্ত মূল হাটের চার ভাগের এক ভাগ ভরেনি। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ব্যাপারী গরু নিয়ে আসে তারা অনেকেই করোনাভাইরাসের কারণে গরুই কেনেনি। এক প্রশ্নের জবাবে আমিনুল বলেন, ঢাকার আশপাশে এখন অনেক বড় বড় গরুর খামার গড়ে উঠেছে। সেখানে ৩৭৫ টাকা কেজি (লাইফ ওয়েট) হিসাব করে গরু বিক্রি করছে। তার চেয়ে অনেক কম দামে আমরা দিচ্ছি তারপরও গ্রাহক নেই। আমার পাশে ২০০ কেজি (লাইফ ওয়েট) ওজনের একটি গরু ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হলো, যার কেজি পড়েছে ৩০০ টাকা। গাবতলীতে দীর্ঘদিন গরুর ব্যবসা করেন জমির আলী। তিনি এখান থেকে গরু কিনে এই হাটেই বিক্রি করবেন। এবারও গরু কিনতে বের হয়েছেন এ ব্যবসায়ী। জমির আলী বলেন, প্রতি বছর এই সময় গাবতলী হাট গরু দিয়ে ভরে যায়। অথচ এবার সেই হাটে গরু এখন পর্যন্ত (১৬ জুলাই) জমছে না। তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে তুলনামূলক গরু এবার সস্তা। গত বছর এ সময়ে যে গরু ৭০ হাজার দিয়ে বিক্রি হয়েছে, এবার তার দাম ৫৫ থেকে ৬০ হাজার। গত ১৪ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ১৬টি গরু কিনেছি। প্রতি গরু দেড় দুই হাজার টাকা লাভ হলে আমিও ছেড়ে দিচ্ছি। গাবতলী হাটে ২০ বছর ধরে ব্যবসা করেন আফজাল সরকার। তিনিও গরু কেনার জন্য ঘুরছেন। গ্রাম থেকে যারা আসে তাদের কাছ থেকে গরু কিনে এই হাটেই বিক্রি করেন। আফজাল বলেন, এবার কোরবানির হাট ভালো জমবে না। কোরবানিও কম হবে। গ্রামগঞ্জের মানুষ এবার গরু কিনছে না। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর আগে কিছু গরু কিনেছিলাম। বুধবার ৪০০ টাকা কেজি গরুর মাংস ধরে ওজন করে গরু বিক্রি করেছি। আজ বসে আছি, গরু কিনব কিনা ভাবছি। গত বছর ২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এবারও ক্ষতিতে পড়েছি। গরু কিনে লাভ করতে পারছি না। কুষ্টিয়া থেকে ১১টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন রকি নামের এক ব্যাপারী। তিনি বলেন, গ্রামেও এখন গরু সস্তা, নেয়ার লোক নেই। তারা যে গরুগুলো এনেছেন গত বছর এই মাপের গরু তিনি ৬০-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এবার ৪৫-৪৮ হাজারের ওপর দাম ওঠেনি। এই দামে গরু বিক্রি করলে ক্ষতি হবে। কারণ এবার গো-খাদ্যের দাম বেশি। ১৫টি গরু নিয়ে পাবনা থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন শাহ আলম। তিনি বলেন, গ্রামেও গরুর বেচাকেনা নেই। এ কারণে আগেভাগে ঢাকায় এসেছি। এখানেও গরুর দাম কম। যে দামে গরুগুলো কিনে এনেছি সে দামও বলছে না। এবার সারাদেশেই গরুর বাজার কম। প্রতি বছরের মতো মানুষ এবার এত কোরবানি দেবে না। গ্রামেও এ বিষয়টি টের পাওয়া গেছে। কারণ করোনার কারণে অনেকের চাকরি নেই। অনেকের বেতন কমে গেছে। অনেকে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন। তাদের পক্ষে এবার কোরবানি দেওয়া সম্ভব না। চুয়াডাঙ্গা থেকে ১২টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন আলম নামের এক খামারি। তিনি বলেন, গরু এসে মনে হচ্ছে ক্ষতি হয়ে গেল। কারণ দুই দিন হয়ে গেল একটি গরুও বিক্রি করতে পারিনি। গত বছর এমন সময়ে নিজের খামারের ১৫টি গরু বিক্রি করে আবার বাড়ি গিয়ে বড় ভাইয়ের খামারের ১০টি গরু নিয়ে এসে বিক্রি করেছিলাম। এবার হাটের হাবভাব ভালো লাগছে না। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর তিনমাস আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যাপারীরা গরু কিনেছেন। এবার একটা ব্যাপারীও দেখা যায়নি। তারা করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে।
Leave a Reply